ভাষা আন্দোলন
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠনের পর পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরাই পাকিস্তান সরকারে প্রাধান্য পায়। পাকিস্তান সরকার ঠিক করে উর্দু ভাষাকে সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা করা হবে, যদিও পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু ভাষার চল ছিলো খুবই কম। পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ (যারা সংখ্যার বিচারে সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন) এই সিদ্ধান্তকে মোটেই মেনে নিতে চায়নি। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবীতে শুরু হয় আন্দোলন।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর খাজা নাজিমুদ্দিন জানান যে পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া হবে। এই ঘোষণার ফলে আন্দোলন আরো জোরদার হয়ে ওঠে। পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি ক'রে মিটিং-মিছিল ইত্যাদি বে-আইনি ঘোষণা করে। ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালে এই আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এর অনেক ছাত্র ও আরো কিছু রাজনৈতিক কর্মীরা মিলে একটি মিছিল শুরু করেন। মিছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ-এর কাছে এলে পুলিস মিছিলের উপর গুলি চালায়। গুলিতে নিহত হন আব্দুস সালাম,রফিক, বরকত, জব্বার সহ আরো অনেকে। এই ঘটনার প্রতিবাদে সারা পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ও তীব্র আকার ধারন করে। অবশেষে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় বাংলা ও উর্দুভাষাকে সম-মর্যাদা দিতে।
এই আন্দোলন পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপন করে দিয়েছিল। এই আন্দোলনের স্মৃতিতে পরবর্তী কালে গড়ে তোলা হয় শহীদ মিনার, ঠিক সেই জায়গাতে যেখানে প্রাণ হারিয়েছিলেন রফিক, বরকত, জব্বাররা। ২১ ফেব্রুয়ারী দিনটি বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন দিবস হিসাবে পালিত হয়। ১৯৯৯ সাল থেকে জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারী তারিখটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছে।
[সম্পাদনা করুন] ভাষা আন্দোলন পরিক্রমা
ডিসেম্বর, ১৯৪৭: ২৭ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপনের প্রতিবাদে ছাত্রশিক্ষক সমাজের আন্দোলন এবং প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত।
ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮: ২৩শে ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের অধিবেশনে পরিষদে ব্যবহারযোগ্য ভাষা হিসাবে উর্দু ও ইংরেজি ভাষা নির্ধারণ। বাংলা ভাষাকে ব্যবহারযোগ্য ভাষা হিসাবে গ্রহণ করার প্রস্তাব বাতিল। ২৬ ফেব্রুয়ারি এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ছাত্রদের শিক্ষাঙ্গনে বিক্ষোভ।
মার্চ, ১৯৪৮: ২রা মার্চ দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন। ১১ই মার্চ প্রতিবাদ দিবস পালন। ঐদিন ছাত্র জনতার বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে অনেকে পুলিশী নির্যাতনের শিকার এবং গ্রেফতার হন। ১৩ মার্চ ঢাকায় এবং ১৪ মার্চ সারা দেশে ছাত্র ধর্মঘট পালন। ১৫ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালন। আন্দোলন অব্যাহত। ২১ মার্চ এক জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উল্লেখ করলে তাৎক্ষনিকভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন।
মার্চ ১৯৫০: ১১ মার্চ নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন এবং আন্দোলন অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা।
জানুয়ারি, ১৯৫২: ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় এসে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষনা। প্রতিক্রিয়ায় ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০শে জানুয়ারি ঢাকার শিক্ষাঙ্গনে ধর্মঘট পালন। ৩১শে জানুয়ারি মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে 'সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠন।
ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২: ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট পালন এবং ঢাকায় প্রতিবাদ সভার পর ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী আন্দোলনের সিদ্ধান্ত। ২০শে ফেব্রুয়ারি সরকার কর্তৃক এক মাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি। ঐদিন রাতে 'সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' কর্তৃক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত এবং পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র বিক্ষোভ এবং পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদ ঘেরাওয়ের চেষ্টা করলে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ। বেলা তিনটায় বিক্ষোভরত ছাত্র জনতার উপর পুলিশের গুলিবর্ষনে আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমেদ ও আবদুল জব্বার নিহত। পরদিন শহীদদের গায়েবি জানাজা শেষে প্রতিবাদী মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষনে শফিউর রহমান, আবদুল আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহ সহ আরো অনেকে নিহত। ২৩শে ফেব্রুয়ারি এক রাতের শ্রমে শহীদ মিনার তৈরি করে কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ কর্তৃক তা ভেঙ্গে ফেলা হয়।
মে, ১৯৫৪: অব্যাহত আনোলনের পটভূমিতে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে ৯ মে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গৃহীত হয়।