চানক্য
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
চানক্য ভারতের কূটনৈতিক ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্র গুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
সূচিপত্র |
[সম্পাদনা করুন] জন্ম
এই বিজ্ঞ ও প্রতিভাধর ব্রাহ্মণের জন্ম বর্তমান পাকিস্তানের তক্ষশীলায়; যেখানে উপমহাদেশে উচ্চতর জ্ঞান আহরণের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপীঠ অবস্থিত ছিল। রাজনৈতিক দর্শনের বাস্তব চর্চা ও রাষ্ট্রীয় কৌশলের প্রয়োগ পদ্ধতির নির্দেশনা দানে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাসে তার অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী।
বিষ্ণুগুপ্ত নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি। কারণ এ নামটিই দিয়েছিলেন তার বাবা মা। এছাড়া তার বিখ্যাত ছদ্মনাম 'কৌটিল্য', যা তিনি তার বিখ্যাত সংস্কৃত গ্রন্থ 'অর্থশাস্ত্র' এ গ্রহণ করেছেন। রাষ্ট্রশাসন ও কূটনীতির কৌশলের সারসংক্ষেপ বলা যায় 'অর্থশাস্ত্রকে'। যেহেতু তিনি 'কূটিলা গোত্র' থেকে উদ্ভুত ছিলেন, অতএব তা টিকিয়ে রাখার জন্যে তিনি 'কৌটিল্য' ছদ্মনাম গ্রহণ করেছিলেন। অন্যদিকে তার অধিকতর প্রিয় নাম 'চানক্য' এর উদ্ভব 'চানকা' থেকে, যে গ্রামে তার জন্ম হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে।
[সম্পাদনা করুন] নন্দ বংশকে উৎখাত
তার অসাধারণ কৃতিত্ব ছিল প্রচণ্ড শক্তিশালী নন্দ বংশের শাসন উত্খাত করে সম্রাট অশোকের পিতামহ [চন্দ্র গুপ্ত মৌর্য|[চন্দ্র গুপ্ত মৌর্যকে]] ভারতের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা। চন্দ্র গুপ্ত মৌর্যকেই উপমহাদেশের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চন্দ্র গুপ্ত মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং পাটলিপুত্রকে তার রাজ্যের রাজধানীতে পারিণত করেন। পাটলিপুত্র বিহারের আধুনিক শহর পাটনার কাছেই অবস্থিত ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৯৮ সাল পর্যন্ত চন্দ্র গুপ্ত রাজ্য শাসন করেন। তার সময়কালে সমগ্র রাজ্য জুড়ে শান্তি বিরাজমান ছিল, প্রজাদের প্রতি তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ এবং রাজ্য বিকশিত হয়েছিল সমৃদ্ধিতে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করে গেছেন চন্দ্র গুপ্তের দরবারে গ্রীক দূত মেগাস্থিনিস তার 'ইন্ডিকা' গ্রন্থে।
নন্দ বংশের সর্বশেষ রাজা প্রজা সাধারণের কাছে প্রিয় ছিলেন না। একবার তিনি চানক্যকে অপমান করেছিলেন। চানক্য এই অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের প্রতিজ্ঞা করেন। এদিকে তরুণ ও উচ্চাভিলাষী চন্দ্র গুপ্ত, যিনি নন্দ রাজার পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন, তিনিও ষড়যন্ত্র করছিলেন সিংহাসন দখলের। কিন্তু তার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয় এবং জীবন বাঁচাতে তাকে পালাতে হয়। চন্দ্র গুপ্ত যখন বিন্ধানের জঙ্গলে পলাতক ও নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন তখন ঘটনাচক্রে চানক্যের সাথে তার সাক্ষাত্ হয়। চন্দ্র গুপ্ত তার জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন চানক্যকে এবং তখনই তাকে তার গুরু, উপদেষ্টা ও মন্ত্রণাদাতা হিসেবে মেনে নেন। পরবর্তীতে তিনি চন্দ্র গুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন।
চানক্যের সক্রিয় সাহায্যে চন্দ্রগুপ্ত একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন এবং গুরুর তৈরি সুনিপুণ পরিকল্পনা অনুসারে পদক্ষেপ গ্রহণ করে শেষ পর্যন্ত নন্দ রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করতে সক্ষম হন। অতঃপর মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন চন্দ্র গুপ্ত মৌর্য।
[সম্পাদনা করুন] প্রধানমন্ত্রী চানক্য
এর আগে আলেকজান্ডারের আকস্মিক মৃত্যুতে গ্রীক শাসনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে বিদ্রোহের সূচনা হয় এবং এ পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে চন্দ্র গুপ্ত গ্রীক বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে পরাজিত করেন ও পাঞ্জাবকে নিজ শাসনাধীনে আনেন। পরে চন্দ্র গুপ্ত একে একে পশ্চিম ভারতের সকল রাজ্য বিজয় করে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সাম্রাজ্য দক্ষতার সাথে পরিচালনার জন্যে তিনি একটি মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন চানক্যকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করে।
যে পরিস্থিতিতে চন্দ্র গুপ্ত নন্দ বংশকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজের বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন তা অত্যন্ত চমত্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে পঞ্চম শতাব্দীতে লিখিত একটি রাজনৈতিক নাটক 'মুদ্রা রাক্ষস'এ। এ নাটকের রচয়িতা বিশাখাদত্ত নামে এক প্রাচীন নাট্যকার। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই নাটকটি পঠিত, মঞ্চস্থ ও প্রশংসিত হয়েছে।
চন্দ্র গুপ্তের শ্রদ্ধেয় গুরু ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চানক্য অবলীলায় বিলাসবহুল জীবন কাটাতে পারতেন জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদে। কিন্তু তিনি এর পরিবর্তে খুব সাধারণভাবে একটি কুড়েঘরে বসবাসের জীবন বাছাই করে নিয়েছিলেন। এই কুড়েঘরটি অবস্থিত ছিল এক শ্মশানে। সেখানে ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে দূরে অবস্থান করে তিনি বহু শিষ্যকে রাজ্যশাসনের কৌশল শিক্ষা দিয়েছেন এবং নৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিষয়ে জ্ঞান দান করেছেন। এসব ছাড়াও তিনি তার রাজার দেয়া দায়িত্ব পালন করেছেন বিশ্বস্ততার সাথে। চন্দ্রগুপ্তের জীবনে তিনি ছিলেন অভিভাবক স্বর্গীয় দূতের মতো এবং সত্যিকার বন্ধু, দার্শনিক ও গুরু।
[সম্পাদনা করুন] চানক্যের অর্থশাস্ত্র
চানক্যের বিরাট সাহিত্য কর্ম 'অর্থশাস্ত্র', যার শব্দগত অর্থ 'পৃথিবীতে সাধারণ কল্যাণ বিষয়ক বিবরণী।' এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে শাসকের উদ্দেশ্যে পরামর্শ যে, কিভাবে একজন শাসককে তার প্রজাদের নিরাপত্তা, কল্যাণ ও জীবন মান উন্নত করার জন্যে কাজ করতে হবে এবং কিভাবে আরো ভূখন্ড ও মূল্যবান সম্পদ নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করতে হবে। চানক্য যে সব পরামর্শ বা নির্দেশনা সেই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন সেসবের অধিকাংশই শুধু রাজ্যশাসন নয় বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। চানক্য উপমহাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম প্রবক্তা এবং তার কিছু নীতি বিশ্বজনীনভাবে প্রযোজ্য।
এই বিজ্ঞ ও বাস্তবজ্ঞান সম্পন্ন দার্শনিক ধর্ম, নীতিশাস্ত্র, সামাজিক আচরণ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করেছেন। এসবের কিছু কিছু অন্যান্য বিবরণীতে সংগৃহীত হয়েছে। এ ধরণের একটি সংকলনের নাম 'চানক্য নীতি দর্পণ'। তার কথাগুলো হয়তো আধুনিক যুগের পরিশীলিত কথাবার্তা থেকে ভিন্ন, কিন্তু দুই হাজার বছরের অধিক সময়ের ব্যবধানেও সেগুলো গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেনি।
চানক্য তার কালোত্তীর্ণ গ্রন্থ 'অর্থশাস্ত্রে' রাজাকে পরামর্শ দিয়েছেন, "যে রাজা শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা করতে পারে না এবং শুধু অভিযোগ করে যে তার পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, তাকে সিংহাসনচ্যুত করা উচিত।" অর্থনৈতিক দুর্নীতি সর্বকালেই ছিল এবং চানক্যের যুগেও তা নতুন কোন বিষয় ছিল না। সে কারণে তিনি লিখেছেন, "সকল উদ্যোগ নির্ভর করে অর্থের ওপর। সেজন্যে সবচেয়ে অধিক মনোযোগ দেয়া উচিত খাজাঞ্চিখানার দিকে। তহবিল তসরূপ বা অর্থ আত্মসাতের চল্লিশটি পদ্ধতি আছে। জিহ্বা'র ডগায় বিষ রেখে যেমন মধুর আস্বাদন করা সম্ভব নয়, তেমনি কোন রাজ কর্মচারির পক্ষে রাজার রাজস্বের সামান্য পরিমাণ না খেয়ে ফেলার ঘটনা অসম্ভব ব্যাপার। পানির নিচে মাছের গতিবিধি যেমন পানি পান করে বা পান না করেও বুঝা সম্ভব নয়, অনুরূপ রাজ কর্মচারির তহবিল তসরূপও দেখা অসম্ভব। আকাশের অতি উঁচুতেও পাখির উড্ডয়ন দেখা সম্ভব, কিন্তু রাজ কর্মচারির গোপন কার্যকলাপ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সমভাবে অসম্ভব।"
চানক্য তার নীতিকথায় বলেছেন, "বিষ থেকে সুধা, নোংরা স্থান থেকে সোনা, নিচ কারো থেকে জ্ঞান এবং নিচু পরিবার থেকে শুভলক্ষণা স্ত্রী - এসব গ্রহণ করা সঙ্গত।"
"মনের বাসনাকে দূরীভূত করা উচিত নয়। এই বাসনাগুলোকে গানের গুঞ্জনের মতো কাজে লাগানো উচিত।"
"যারা পরিশ্রমী, তাদের জন্যে কোনকিছু হাসিল করা অসাধ্য কিছু নয়। শিক্ষিত কোন ব্যক্তির জন্যে কোন দেশই বিদেশ নয়। মিষ্টভাষীদের কোন শত্রু নেই।"
"বিরাট পশুপালের মাঝেও শাবক তার মাকে খুঁজে পায়। অনুরূপ যে কাজ করে অর্থ সবসময় তাকেই অনুসরণ করে।"
"মন খাঁটি হলে পবিত্র স্থানে গমন অর্থহীন।"
[সম্পাদনা করুন] অনাড়ম্বর জীবন-যাপন
চানক্য তার জীবদ্দশায়, এমনকি মৃত্যুর পরও ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও ব্যতিক্রমী প্রতিভার অধিকারী পণ্ডিত, সাধু, দেশপ্রেমিক, গুরু ও কর্মবীর হিসেবে শ্রদ্ধেয়। প্রথমেই তিনি পাঞ্জাবকে বিদেশী শাসন (গ্রীক) মুক্ত করতে রাজাকে সাহায্য করেন। এরপর অযোগ্য শাসক নন্দ রাজাকে উত্খাত করে চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যের সাথে আরো রাজ্য যুক্ত করেন এবং সাম্রাজ্যে শান্তি, সমৃদ্ধি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তার ভূমিকা পালন করেন। সন্যাসীর মতো জীবন যাপন করেন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেও। অসংখ্য শিষ্যকে তিনি জ্ঞান দান করেন। তিনি শিষ্যদের দেশপ্রেম, রাজার প্রতি আনুগত্য শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি প্রজাদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে সবসময় রাজাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের মতোই চানক্যের চেহারাও সুন্দর বা আকর্ষণীয় ছিলনা এবং দৈহিক গড়নও ছিল আকর্ষণহীন। দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন তিনি, যদিও সক্রেটিসের মতোই পন্ডিত ও দার্শনিক ছিলেন। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন যে, "দেহের সৌন্দর্যের চাইতে চিন্তার সৌন্দর্য অধিকতর মোহময় ও এর প্রভাব যাদুতুল্য।" অন্যদিকে চানক্য ছিলেন দক্ষ পরিকল্পনাবিদ। সিদ্ধান্তে তিনি ছিলেন অটল এবং অর্থহীন আবেগের কোন মূল্য ছিল না তার কাছে। নিজস্ব পরিকল্পনা উদ্ভাবন ও তা বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন কঠোর।