কিশোর কুমার
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
কিশোর কুমার গাঙ্গুলি (আগস্ট ৪, ১৯২৯ – অক্টোবর ১৩, ১৯৮৭) একজন বিখ্যাত ভারতীয় বাঙালি গায়ক এবং নায়ক। অসাধারণ প্রতিভাশালী এই মানুষটি ভারতের শ্রেষ্ঠতম প্লেব্যাক গায়কদের অন্যতম। সাধারনত গায়ক হিসাবে তাঁকে দেখা হলেও তিনি হিন্দি সিনেমা জগতের একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতাও ছিলেন। তাঁর অভিনেতা হিসাবে বিখ্যাত কয়েকটি কমেডি সিনেমার ভিতর রয়েছে বাপ রে বাপ (১৯৫৫), চলতি কা নাম গাড়ি (১৯৫৮), হাফ টিকিট (১৯৬২), পড়োশন (১৯৬৮), হাঙ্গামা (১৯৭১), পেয়ার দিবানা (১৯৭৩), বাড়তি কা নাম দাড়ি (১৯৭৪), এছাড়া অন্যান্য সিনেমার ভিতর রয়েছে – নোকরি, বন্দী, দূর গগন কি ছাঁও মে, দূর কা রাহি প্রভৃতি। এছাড়া কিশোর কুমার নানা সময়ে সফলভাবে গীতিকার, সুরকার, প্রযোজক, পরিচালক এবং চিত্রনাট্যকারের ভূমিকা পালন করেছেন।
সূচিপত্র |
[সম্পাদনা করুন] ছোটবেলা
কিশোর কুমার মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়াতে এক মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কুঞ্জলাল গাঙ্গুলি ছিলেন একজন উকিল। তাঁর মার নাম ছিল গৌরী দেবী। কিশোর কুমারের ছোট বেলায় নাম ছিল আভাস কুমার গাঙ্গুলি। চার ভাই বোনের ভিতর কিশোর ছিলেন সবথেকে ছোট। সবথেকে বড় ছিলেন অশোক কুমার তারপর সীতা দেবী। তারপর অনুপ কুমার আর অনুপ কুমারের থেকে পাঁচ বছরের ছোট ছিলেন কিশোর কুমার।
কিশোরের ছোট থাকা কালীনই তাঁর বড়দা অশোক কুমার বোম্বেতে হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে বড় সাফল্য পান। এই সফলতা ছোট কিশোরের উপরে বড় প্রভাব ফেলেছিল। ছোটবেলা থেকেই কিশোর বিখ্যাত গায়ক কুন্দন লাল সায়গলের একজন বড় ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি সায়গলের নকল করে গান করতেন। এছাড়াও তাঁর বাড়ির লোক তাঁকে দাদা অশোক কুমারের বিখ্যাত গান “মেঁ বন কে পঞ্ছী বন বন কে” বার বার গাইতে বলতেন। অশোক কুমারের সাফল্যের পর কিশোরের আরেক দাদা অনুপ কুমারও বোম্বের হিন্দি সিনেমা জগতে প্রবেশ করেন।
[সম্পাদনা করুন] কর্মজীবন
[সম্পাদনা করুন] পঞ্চাশের দশকের সাফল্য
কিশোর কুমারের অভিনয় খুব একটা পছন্দ ছিল না। তিনি গান গাইতেই চাইতেন। কিন্তু তাঁর গানের কোন ধরাবাঁধা শিক্ষা ছিল না। দাদা অশোক কুমারের ফিল্ম জগতে অনেক পরিচিতি থাকার ফলে কিশোর বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পান কিন্তু সেগুলিতে তেমন সাড়া জাগাতে পারেননি। তবে এই সিনেমাগুলোয় তিনি গান গাইবার সুযোগ পেতেন। এই প্রাথমিক অবস্থায় তিনি কুন্দন লাল সায়গলের নকল করে গাইতেন। পরে শচীন দেব বর্মনের পরমর্শে তিনি নিজের গাইবার কায়দা পালটান এবং এমন এক গাইবার কায়দা উদ্ভাবন করেন যা সেই সময়ের অপর প্রধান দুই গায়ক মহম্মদ রফি এবং মুকেশের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর গানের বৈশিষ্ট্য ছিল গলাকে ভেঙে গান গাওয়া যা আগে কখনও শোনা যায়নি। তবে এই কায়দা খুবই জনপ্রিয় হয়। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত কমেডি নায়ক হিসাবে জনপ্রিয় হন। তাঁর অভিনয়ের কায়দা ছিল অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সেই সময়ের তিন প্রবল জনপ্রিয় এবং ক্ষমতাশালী তিন নায়ক রাজ কাপুর, দেব আনন্দ এবং দিলীপ কুমার বলিউড শাসন করা সত্বেও কিশোর কুমার নিজের এক পৃথক জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হন। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে তিনি ছিলেন এক প্রবল ব্যস্ত এবং সফল নায়ক এবং গায়ক । এছাড়াও তিনি সুরকার, গীতিকার এবং প্রযোজকের ভূমিকাও পালন করতে লাগেন। শচীনদেব বর্মন ছাড়াও আরেক সুরকার যিনি কিশোরের সঙ্গীত প্রতিভা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি হলেন খেমচাঁদ প্রকাশ। খেমচাঁদ প্রকাশের সুর জিদ্দি সিনেমার গান গেয়ে কিশোর গায়ক হিসাবে পায়ের নিচে মাটি পান। এছাড়া অন্যান্য সুরকার যেমন রবি এবং দুই বিশিষ্ট গীতিকার মজরু সুলতানপুরি এবং শৈলেন্দ্র কিশোরের ভক্ত হয়ে ওঠেন। এই সময়ের তাঁর গায়ক হিসাবে অন্যতম সিনেমাগুলির ভিতর আছে পেয়িং গেস্ট (১৯৫৭), চলতি কা নাম গাড়ি (১৯৫৮), তিন দেবিয়াঁ,
[সম্পাদনা করুন] ষাটের দশকের ব্যর্থতা
ষাটের দশকের শুরু থেকেই কিশোরের কেরিয়ারে ব্যর্থতা ঘনিয়ে আসে। কিশোরের অধিকাংশ সিনেমাই ফ্লপ হয়। এবং এই সময়ের কিশোরের খুব কম গানই আছে মনে রাখার মত। মুনিমজি (১৯৬২), গাইড (১৯৬৫) এবং জুয়েল থিফ (১৯৬৭) ছাড়া মনে রাখার মত বেশি গানও তিনি গাননি। ১৯৬৬ সালে সুরকার হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটে শচীনদেব বর্মনের পুত্র রাহুলদেব বর্মনের। তাঁর প্রথম সুপারহিট সিনেমা তিসরি মঞ্জিলে কিশোর কোন গান গাননি। কিন্তু ১৯৬৮ সালে পড়শন সিনেমায় রাহুলের সুরে কিশোর বেশ কয়েকটি হিট গান গান।
[সম্পাদনা করুন] চরম সাফল্য
১৯৬৯ সালে শক্তি সামন্তর আরাধনা রিলিজ করে। এই সিনেমার নায়ক ছিলেন নবাগত রাজেশ খান্না। রাজেশ খান্নার জন্য এই সিনেমায় কিশোর তিনটি গান গেয়েছিলেন। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ডুয়েট ‘কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা’, রূপ তেরা মস্তানা এবং ‘মেরে সপনো কি রানী’। তিনটি গানই বিপুল সাফল্য পায় এবং কিশোর কুমারের কেরিয়ারকে আবার উপরে উঠিয়ে দেয়। এই সিনেমায় রূপ তেরা মস্তানা গানের জন্য কিশোর প্রথম বার ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পান।
পরবর্তী বছর গুলোতে কিশোর গায়ক হিসাবে চরম সাফল্য পান। সে সময়ে বলিউডে প্রতিষ্ঠিত সব নায়ক যেমন রাজেশ খান্না, শশী কাপুর, ধর্মেন্দ্র, রণধীর কাপুর, সঞ্জীবকুমার, এবং দেব আনন্দের গলায় তিনি গান গান। এই সময়ে শচীন দেব বর্মন এবং রাহুল দেব বর্মনের সুরে তিনি প্রচুর কালজয়ী গান গেয়েছেন। রাহুল দেব বর্মনের সুরে তিনি বম্বে টু গোয়া সিনেমাতে প্রথমবারের জন্য অমিতাভ বচ্চনের জন্য গান করেন। ১৯৭৩ সালে অমিতাভের অভিমান সিনেমার জন্য তাঁর গানগুলি সুপারহিট হয়। এরফলে পরবর্তী মেগাস্টার অমিতাভের নেপথ্য গায়ক হিসাবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
কিশোরের এই সাফল্যের পরে বলিউডের অন্য সুরকারেরাও তাঁকে নিজেদের প্রধান গায়ক হিসাবে বেছে নিতে বাধ্য করে। এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলাল জুটি। গীতিকার আনন্দ বক্সী সুরকার লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলাল এবং কিশোরকুমার জুটি বেশ কিছু রাজেশ খান্নার সিনেমার জন্য অনবদ্য সঙ্গীত উপহার দেন। যেমন দাগ, রোটি, হাথি মেরে সাথি। লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলালের সুরেই কিশোর এবং মহম্মদ রফি একসাথে গান করেন এবং কিশোর এবং লতা মঙ্গেশকরের বেশ কিছু ভাল ডুয়েট গান তৈরি হয়।
কিশোর কুমার এবং সুরকার কল্যাণজী-আনন্দজী জুটিও বেশ কিছু হিট গান উপহার দেন। যেমন ধর্মাত্মা, লাওয়ারিস, কাবিলা, জনি মেরা নাম, ডন, কাগজ, সফর, মুকাদ্দর কা সিকন্দর প্রভৃতি সিনেমার গান। সত্তরের দশক এবং আশির দশক জুড়ে কিশোরের জয়যাত্রা চলতেই থাকে। নতুন অল্পবয়েসি নায়ক যেমন ঋষি কাপুর এবং সঞ্জয় দত্তের জন্যও তিনি সফল গান উপহার দেন। রাহুলদেব বর্মনের সুরেই যে তিনি সবথেকে বেশী হিট গান করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। রাহুল এবং কিশোর জুটির কিছু অনবদ্য সিনেমার নাম হল শোলে, ওয়ারান্ট, হীরা পান্না, শরীফ বদমাশ, আঁধি, রকি, দ্য বার্নিং ট্রেন, আপকি কসম, আপনা দেশ, ধরম করম, টক্কর, সীতা আউর গীতা, জোশিলা, কসমে ভাদে, রামপুর কা লক্ষ্মন, কালিয়া, গোলমাল প্রভৃতি । নতুন সুরকার যেমন রাজেশ রোশন এবং বাপী লাহিড়ির সুরেও তিনি বেশ কিছু হিট গান গেয়েছেন। রাজেশ রোশনের সুরে দো অর দো পাঁচ, দুসর আদমি, মনপসন্দ, এবং বাপ্পী লাহিড়ির সুরে নমক হালাল এবং শরাবী সিনেমার গান উল্লেখযোগ্য। তাঁর পুরো কেরিয়ারে কিশোর আটবার শ্রেষ্ঠ গায়কের ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পান।
[সম্পাদনা করুন] বাংলা গান ও চলচ্চিত্র
হিন্দির পাশাপাশি তিনি প্রচুর জনপ্রিয় বাংলা সিনেমার গান এবং বাংলা আধুনিক গানও গেয়েছেন। উত্তম কুমারের জন্য তাঁর প্লেব্যাক করা উল্লেখযোগ্য ছবির ভিতর রয়েছে রাজকুমারী,অমানুষ, আনন্দ আশ্রম, এবং ওগো বধূ সুন্দরী। একটি বাংলা ছবি লুকোচুরিতে তিনি নায়কের অভিনয় এবং গান করেছেন। সত্যজিৎ রায়ের দুটি সিনেমা চারুলতাএবং ঘরে বাইরের জন্য তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছিলেন । বাংলা সিনেমার বিখ্যাত দুই নায়ক প্রসেনজিৎ এবং তাপস পালের কেরিয়ারের দুই উল্লেখযোগ্য হিট যথাক্রমে অমর সঙ্গীএবং গুরুদক্ষিনার জন্যও তিনি প্লেব্যাক করেছিলেন । কেরিয়ারের শেষ দিকে কিশোর কুমার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের তত্বাবধানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবাম রেকর্ড করেন ।
[সম্পাদনা করুন] কিশোর কুমারের প্লেব্যাক করা কিছু বাংলা ছবি
- জীবন মরণ
- দোলন চম্পা
- মিলন তিথি
- পাপ পুণ্য
- জ্যোতি
- গুরুদক্ষিনা
- বান্ধবী
- অমরকন্টক
- সঙ্কল্প
- তুমি কত সুন্দর
- মোহনার দিকে
- আশ্রিতা
- অনিন্দিতা
- সুরের আকাশে
- কবিতা
- অমর সঙ্গী
[সম্পাদনা করুন] কিশোর কুমারের কিছু জনপ্রিয় বাংলা গান
- এক পলকের একটু দেখা
- একদিন পাখী উড়ে যাবে যে আকাশে
- নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে (কিশোর কুমারের নিজের সুর করা)
- আমার মনের ময়ূর মহলে
- হাওয়া মেঘ সরায়ে
- এই তো জীবন হিংসা বিবাদ দ্বেষ হোক নিঃশেষ
- কি আশায় বাঁধি খেলাঘর
- এ আমার গুরুদক্ষিনা
- আমার পূজার ফুল
- এই যে নদী
- শুনো শুনো গো সবে
- তোমায় পড়েছে মনে
- কি উপহার সাজিয়ে দেব
- প্রেমের খেলা কে বুঝিতে পারে
- নীল নীল আকাশে
[সম্পাদনা করুন] ব্যক্তিগত জীবন
কিশোর কুমার চারবার বিয়ে করেছেন। রুমা গুহ ঠাকুরতা (১৯৫০-১৯৫৮), মধুবালা(১৯৬০-১৯৬৯), যোগিতা বালী(১৯৭৫-১৯৭৮) এবং লীনা চন্দাভারকর (১৯৮০-১৯৮৭) কিশোরের প্রথম পুত্র ( রুমা গুহ ঠাকুরতার সাথে) অমিত কুমার একজন বিখ্যাত গায়ক। তিনি তাঁর বাবার মত সাফল্য না পেলেও বেশ কিছু হিট গান উপহার দিয়েছেন। কিশোরের ছোট ছেলে সুমিত কুমার ( লীনা চন্দাভারকরের সাথে) একজন গায়ক হবার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
[সম্পাদনা করুন] মৃত্যু
১৯৮৭ সালের ১৩ই অক্টোবর এই মহান শিল্পীর মৃত্যু ঘটে।
[সম্পাদনা করুন] প্রভাব
হিন্দি সিনেমার সঙ্গীতের উপর তাঁর প্রভাব এখনও বিশাল। এখনকার প্রতিষ্ঠিত অনেক গায়ক যেমন কুমার শানু, অভিজিৎ, বাবুল সুপ্রিয়, অমিত কুমার প্রায় সকলেই তাঁদের কেরিয়ারের প্রথম দিকে কিশোরের নকল করে গাইতেন। তাঁর গানের এখনও খুব ভাল বাজার। তাঁর গানেক রিমেক এবং রিমিক্স বাজারে হু হু করে বিক্রি হয়।
[সম্পাদনা করুন] পুরস্কার
কিশোর কুমার মোট আটবার ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ গায়কের পুরস্কার পেয়েছেন ।
- ১৯৬৯ রূপ তেরা মস্তানা (আরাধনা)
- ১৯৭৫ দিল অ্যায়সা কিসি নে মেরা তোড়া (অমানুষ)
- ১৯৭৮ খাইকে পান বনারস বালা (ডন)
- ১৯৮০ হাজার রাঁহে (থোড়িসি বেবফাই)
- ১৯৮২ পগ ঘুঙরু বাঁধ মীরা (নমক হালাল)
- ১৯৮৩ অগর তুম না হোতে (অগর তুম না হোতে)
- ১৯৮৪ মঞ্জিলে আপনি জাগা (শরাবী)
- ১৯৮৫ সাগর কিনারে (সাগর)
[সম্পাদনা করুন] তথ্যসূত্র
ইংরাজী উইকিপিডিয়া